চিকিৎসকদের ফি নির্ধারণসহ নানা সংস্কারের প্রস্তাব করে স্বাস্থ্যসেবা ও সুরক্ষা আইনের খসড়া করা হয়েছিল ১১ বছর আগে। কিন্তু তৎকালীন ক্ষমতাসীন দলের সমর্থনপুষ্ট চিকিৎসকদের সংগঠন স্বাচিপের বিরোধিতায় তা আলোর মুখ দেখেনি। ২০১৮ সালে আবার খসড়াটি মন্ত্রিসভায় নীতিগত অনুমোদন হয়। তখনো হয়নি। চলতি বছরও সাবেক স্বাস্থ্যমন্ত্রী ডা. সামন্ত লাল সেনও আইনটি করার চেষ্টা করেছিল। কিন্তু হয়নি। তবে বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার অংশীজনদের সঙ্গে ও আন্তঃমন্ত্রণালয় সভা করে আইনটির প্রস্তাবনায় কিছু সংযোজন বিয়োজন করে নতুন করে প্রাথমিক খসড়া তৈরি করেছে, যা স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের ওয়েবসাইটে দেওয়া আছে। আগামী ৩০ নভেম্বর পর্যন্ত এসব বিষয়ে মতামত দেওয়া যাবে।
খসড়া এই অধ্যাদেশের কাঠামো নিয়ে সরাসরি কাজ করছেন স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের যুগ্মসচিব অতুল সরকার। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, দীর্ঘদিন থেকে এই অধ্যাদেশটি করার কাজ করছে মন্ত্রণালয়। নানা বাস্তবতায় এটি করা সম্ভবপর হয়নি। আগে অংশীজনদের মতামত নেওয়া হয়েছে। এখন মন্ত্রণালয়ের ওয়েবসাইটে প্রকাশ করা হয়েছে। পরে মন্ত্রণালয়ের বিবেচনা সংযুক্ত করে এটি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে পাঠানো হবে। এরপর এটি আইন মন্ত্রণালয়ে ভেটিং শেষে উপদেষ্টা পরিষদে পাস হলে অধ্যাদেশ জারি হবে।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা জানিয়েছেন, আইনটি নানা কারণেই প্রয়োজন। চিকিৎসকরা ইচ্ছেমতো ফি নির্ধারণ করেন। এখানে কোনো নিয়ন্ত্রণ নেই। এই আইনটি হলে ইচ্ছেমতো ফি নির্ধারণ করা যাবে না। শুধু চিকিৎসকদের ফি-ই নয়, অন্যান্য নমুনা (রোগ নির্ণয়ে) পরীক্ষা-নিরীক্ষার ফি নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণে থাকবে। এ ছাড়া প্রতিবছরই প্রচুর রোগী বিদেশে যায়। বিনিয়োগের সুযোগ দেওয়া হলে এখানেই বিদেশি হাসপাতাল হবে। চিকিৎসাসেবায় অবহেলাজনিত ক্ষতি যেমন অঙ্গপ্রত্যঙ্গ হারানো, দৃষ্টিশক্তি হারানো, চিকিৎসা খরচ বেশি রাখা, প্রজনন ক্ষমতা হারানো এসব সংগঠিত হলে এ আইনে মামলা করা যাবে। খসড়ায় বেসরকারি হাসপাতালকেও মুমূর্ষু ও সংকটাপন্ন রোগীর জরুরি চিকিৎসাসেবা দেওয়ার বিধান রাখা হয়েছে। এর ফলে আশঙ্কাজনক রোগীকেও চিকিৎসাসেবা দিতে হবে। চিকিৎসাসেবা দেওয়া সম্ভব না হলে উপযুক্ত প্রতিষ্ঠানে পাঠানোর ব্যবস্থা করতে হবে। বর্তমানে বেসরকারি হাসপাতালে গুরুতর আহত রোগীদের চিকিৎসাসেবা না দিয়ে সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যেতে বাধ্য করা হয়। নতুন খসড়ায় চিকিৎসক, হাসপাতাল ও রোগী তিন ক্ষেত্রেই সুরক্ষা দেওয়ার প্রস্তাব রয়েছে।
তবে এই খসড়ায় বেশ কিছু বিষয় সুস্পষ্ট করা হয়নি। গ্রাম বা শহরের চিকিৎসার ধরনের উপযোগিতার অংশগুলো পরিষ্কার করা হয়নি। প্রাথমিক স্বাস্থ্যসেবার বিষয়টি সুস্পষ্ট করা হয়নি। সরকারি হাসপাতালে স্বাস্থ্যসেবার পরিধি, গুণগতমান, সহজলভ্যসহ সার্বিক উন্নয়নের সুনির্দিষ্ট ধারা উল্লেখ করা হয়নি। সরকার স্বাস্থ্য কার্ড, সরকারি স্বাস্থ্য ইনস্যুরেন্স কাভারেজ ব্যবস্থা প্রবর্তনসহ নানা কার্যক্রম, কর্মসূচি গ্রহণ ও বাস্তবায়নের বিষয়টি বললেও কী কী করা হবে, তা ব্যাখ্যা করেনি।
নতুন অধ্যাদেশে চিকিৎসকদের ফি দৃশ্যমান রাখা ও কয়েকটি ধারা নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেলিন চৌধুরী। তিনি দেশ রূপান্তরকে বলেন, বাংলাদেশে উকিল, প্রকৌশলী বা অন্য সেবাদানকারী পেশাজীবীরা কি তাদের ফি দৃশ্যমান রাখেন? যদি না-ই রাখেন, তবে শুধু এটি চিকিৎসকদের সঙ্গে কেন করা হবে। অন্য পেশাজীবীদের সঙ্গে এখানে ডাক্তারদের আলাদা করা হচ্ছে কেন। তিনি বিদেশি ডাক্তারদের নিয়োগ প্রসঙ্গে বলেন, আগে অন্য দেশ থেকে ডাক্তার আসতে হলে বিএমডিসির অনুমতি প্রয়োজন হতো কিন্তু এখন এটি মন্ত্রণালয় সুপারিশ করবে। এতে পক্ষপাতিত্ব বা বিশেষ কাউকে সুযোগ দেওয়ার পথ তৈরি হয়েছে। তিনি বলেন, আইনের খসড়ায় অবশ্যই সেবাসংশ্লিষ্ট অভিযোগের ক্ষেত্রে একটি সালিশি ব্যবস্থা রাখতে হবে। কেউ যদি সেবাবঞ্চিত বা ভুক্তভোগী হওয়ার অভিযোগ করেন, সে ক্ষেত্রে অভিযোগের ৭ থেকে ১০ দিনের মধ্যে উভয় পক্ষের শুনানি করত হবে।
তবে স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের কর্মকর্তারা বলছেন, এসব বিষয় বিধিমালায় উল্লেখ করা হবে।
ওষুধ প্রশাসন অধিদপ্তরকে শক্তিশালীকরণের বিষয়ে প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ গ্রহণে কোনো ধারা সংযোজিত হয়নি। ওষুধের দাম নির্ধারণ ও নিয়ন্ত্রণের জন্য অন্য দেশের মতো ‘ন্যাশনাল ফার্মাসিউটিক্যাল প্রাইসিং অথরিটি’ গঠনের বিষয়ে কোনো ধারায় কিছু উল্লেখ নেই। ইডিসিএল এবং সিএমএসডিকে শক্তিশালীকরণের বিষয়ে কিছু উল্লেখ নেই। রোগীর সুরক্ষা নিশ্চিতে অপ্রয়োজনীয় অপারেশন এবং অপ্রয়োজনীয় আইসিইউর ব্যবহার রহিত করার জন্য কোনো সুনির্দিষ্ট ব্যবস্থার উল্লেখ নেই।
স্বাস্থ্যসেবা বিভাগের অতিরিক্ত সচিব এ টি এম সাইফুল ইসলাম দেশ রূপান্তরকে জানান, খুব দ্রুত সময়েই এই অধ্যাদেশটি করে ফেলতে চাই। সেজন্য কাজ এগিয়ে যাচ্ছে। বেশ কয়েক দফায় আন্তঃমন্ত্রণালয় মতামত গ্রহণ করা হয়েছে। অংশীজনদের মতামতও নেওয়া হয়েছে। খসড়া কেবিনেটে পাঠানোর পর কেবিনেট এই খসড়াটি নিয়ে আরও কিছু সংলাপ, সংযোজন-বিয়োজনের পরামর্শ দিয়েছে। এসব অন্তর্ভুক্ত করার কাজ চলছে। এখন অংশীজনদের মতামত আন্তঃমন্ত্রণালয়কে আবারও অবিহিত করা হবে।
৪৫টি ধারার এই খসড়ায় বলা আছে, জনস্বার্থে বিনামূল্যে, স্বল্পমূল্যে, ভর্তুকিতে বা অন্য কোনো উপায়ে পাবলিক হাসপাতলে চিকিৎসাসেবা দেওয়া হবে। বিদ্যমান কোনো সেবা থেকে চিকিৎসা গ্রহীতাকে বঞ্চিত করা যাবে না। রোগীর ল্যাবরেটরি রিপোর্ট ও প্যাথলজি রিপোর্টে ডিজিটাল সাইন ব্যবহার করা যাবে না, এ ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকের হাতের লেখা স্বাক্ষর থাকতে হবে।
সরকার প্রজ্ঞাপন দ্বারা সরকারি ও বেসরকারি হাসপাতালে সেবা, স্বাস্থ্যসেবার ফি ও রোগ পরীক্ষা-নিরীক্ষার চার্জ বা মূল্য আলাদা আলাদাভাবে নির্ধারণ করে দেবে। এই মূল্য বা ফি-এর তালিকা দৃশ্যমান জায়গায় প্রদর্শন করতে হবে। এসব ধারা না মানলে ২০ লাখ টাকা অথবা ২ বছর কারাদ- দেওয়া হবে। অথবা ২০ লাখ টাকা ও কারাদন্ড উভয় দন্ডই কার্যকর হবে। একই ব্যক্তি দ্বিতীয়বার একই অপরাধ করলে এটি দ্বিগুণ হয়ে যাবে।
এই অধ্যাদেশের আওতায় সরকারের পূর্বানুমতি সাপেক্ষে দেশে প্রচলিত আইন ও বিধিবিধান মেনে সম্পূর্ণ বিদেশি অর্থায়নে অথবা অংশীদারত্বের ভিত্তিতে হাসপাতাল স্থাপনের সুযোগ থাকবে। দেশে অন্যান্য বেসরকারি হাসপাতালের মতো তাদেরও সব বিধিনিষেধ মানতে হবে। একই সঙ্গে পাবলিক, প্রাইভেট হাসপাতালে শর্তসাপেক্ষে বিদেশি চিকিৎসকদের চাকরির সুযোগ থাকবে।
মোবাইল কোর্ট আইন-২০০৯ অনুযায়ী সংগঠিত অভিযোগের ভিত্তিতে ক্ষমতাপ্রাপ্ত ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান সেবাদানকারী প্রতিষ্ঠানে অভিযান পরিচালনার সুযোগ পাবেন এই অধ্যাদেশে। একই সঙ্গে সরকার মনোনীত কমিটি বা কর্মকর্তা হাসপাতাল বা চিকিৎসাসেবা সহায়তা প্রতিষ্ঠানে যেকোনো সময় পরিদর্শনে যেতে পারবেন। সরকার নির্ধারিত ভাড়ায় রোগী পরিবহনে অ্যাম্বুলেন্সসেবা নিশ্চিত করতে হবে। মরদেহ পরিবহনের ক্ষেত্রে ফি নির্ধারিত থাকতে হবে। সরকারের এই দায়িত্বে নিয়োজিত ব্যক্তি নির্ধারিত দায়িত্বের সময়ে অন্য কোনো প্রতিষ্ঠানে সেবা দিতে পারবেন না। এই অপরাধ করলে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তি সরকারি কর্মচারী আইন-২০১৮ অনুযায়ী শাস্তি পাবেন। সরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা না দিয়ে ব্যক্তিগত বা বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে সেবা দিলে ৫ লাখ টাকা পর্যন্ত জরিমানা গুনতে হবে। রোগীর ব্যবস্থাপত্রে চিকিৎসকের পরামর্শ ও ওষুধের নাম সুস্পষ্টভাবে বড় অক্ষরে লিখতে হবে। বেসরকারি হাসপাতালে দরিদ্র রোগীদের জন্য ৩ শতাংশ শয্যা ও প্রতিবন্ধীদের জন্য ১ শতাংশ শয্যা বিনামূল্যে সংরক্ষণ করতে হবে। সরকারি-বেসরকারি প্রত্যেক হাসপাতালে রোগীর চিকিৎসাসেবা-সংক্রান্ত তথ্য ডিজিটাল রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতে হবে। সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ এসব ডেটা পর্যবেক্ষণ করতে পারবে। চিকিৎসাসেবা ব্যাহত হলে বা সেবাগ্রহণকারী ব্যক্তি ক্ষতিগ্রস্ত হলে আদালতে প্রচলিত আইনে শাস্তি হবে। এ ক্ষেত্রে চিকিৎসা প্রদান-সংক্রান্ত অভিযোগের ক্ষেত্রে আদালত দুজন বিশেষজ্ঞসহ ন্যূনতম তিন সদস্যের তদন্ত কমিটির প্রতিবেদন সাপেক্ষে অভিযোগ গ্রহণ করবে। আদালতের পরোয়ানা ছাড়া কাউকে গ্রেপ্তার করা যাবে না। মোবাইল কোর্টের প্রচলিত আইনে মোবাইল কোর্ট দন্ড আরোপ করতে হবে।
চিকিৎসাসেবায় অবহেলার দিকটি নিয়ে খসড়ায় বলা হয়েছে, চিকিৎসার নির্ধারিত প্রটোকল অনুসরণ করতে হবে, ভুল অঙ্গ অপসারণ শাস্তিযোগ্য অপরাধ, ভুল বা অতিরঞ্জিত রিপোর্ট দেওয়া যাবে না, জরুরি ক্ষেত্রে চিকিৎসা দেওয়ার অহেতুক দেরি করা যাবে না, নিজ এখতিয়ারের বাইরে কাউকে চিকিৎসা দেওয়া যাবে না। চিকিৎসকের পরিবর্তে নার্স, আয়া ওয়ার্ড বয় বা অন্য কারও দ্বারা চিকিৎসা করানো চিকিৎসাসেবায় অবহেলা হিসেবে গণ্য হবে এবং এর জন্য দন্ড নির্ধারিত করা হয়েছে।
প্রতিটি হাসপাতালে দুর্ঘটনা, দুর্যোগকালে, ভূমিকম্প ও প্রাকৃতিক বিপর্যয় এবং জনস্বাস্থ্য সংকটে সরকারি নির্দেশনা মানতে বাধ্য হবে।
পাঠকের মতামত